শেষ ক্লাস শেষে: মুহিম মনির
এই তো সেদিন শুরু হলো; আর আজ নাকি শেষ! শেষ ক্লাস করে এলাম আজ। এমবিবিএস শেষ বর্ষের শেষ ক্লাস। স্মরণকালের কোনোদিনই সেরা শিক্ষার্থী ছিলাম না, তবু একদল দেশসেরা মেধাবীর সঙ্গে শিক্ষাজীবনের সবথেকে বেশি সময় কাটাবার, অনেকগুলো ভালো বন্ধু পাওয়ার সৌভাগ্য আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে কতসব কথা। তার কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি! লেখকতা নিয়েই না-হয় বলি দু-চারটে কথা। যা একেবারে জড়িয়ে গেছে জীবনের সঙ্গে।
লেখালেখির শুরু সেই শৈশবে। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরুল একটা ছোটগল্প। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখলাম। দেখেও সেভাবে সম্পৃক্ত হতে পারলাম না। আরেকটু সময় লাগল। মূলত সম্পৃক্ততার শুরু হলো মেডিকেলে এসে। অনন্য আবেশে নিজেকে নিমগ্নতায় তলিয়ে দিতে লাগলাম। একেক বন্ধু একেকশ বিষয়ে পারদর্শী, এই ছিল আমার আমিত্বকে টেনে আনার আবেশী। প্রাণোচ্ছল প্রিয় বন্ধুদের অপার পারদর্শিতা যেন জলসেচ জোগাল আমার লেখক সত্তায়। আরেকবার মন নামল সজীবতার সন্ধানে।
আমি তো ওদের মতো অতোকিছু পারি না। যা পারি তা কেবল এই লেখালেখিটুকু। তাও সেভাবে নয়। তবু মন বলল এবার এ চর্চায় বুঁদ হওয়া যায়। অতএব শুরু হলো কাগজে কলম চালানো। চাউরও হয়ে গেল ঘটনাটা। ‘সাহিত্যিক’ নামে ডাকতে শুরু করল কেউ কেউ। আর আমাকেও পেয়ে বসল লেখালেখির নেশা। সে নেশা, সে ভালোবাসার ঘোরেই এখনও লিখে চলেছি।
তো মাসখানেকের মধ্যেই শেষ করলাম লেখাটি। ভরে রাখলাম ট্রাঙ্কে। এদিকে ক’মাস যেতে না যেতে কানে আসতে লাগল রজতজয়ন্তীর আগমনী ঘণ্টাধ্বনি। তখনই বন্ধুদের কেউ কেউ বলল,
–এ উপলক্ষে একটা বই বের করে ফেল!
ভালো লাগল কথাটা। ভেতরটাও নাড়া দিয়ে উঠল। উপন্যাসের মতো কিছু একটা লিখতে শুরু করলাম। শেষ হলো। টাইপ করালাম বাহাদুর বাজারের এক দোকানে।
এবার প্রকাশের পালা। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এক লেখকবন্ধু প্রকাশনী জোগাড় করে দিতে চেয়েছিল। বলেছিল, পনেরো হাজারের মতো লাগবে। ততদিনে ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষখানে সেই বন্ধুর সাড়া সেভাবে পাচ্ছিলাম না। অথচ ‘প্রথম ব্যাচ ডে’তে বন্ধুরা ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে যে, মেলায় আমার বই বেরুবে।
কী করি না-করি বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক সে-মুহূর্তে জানলাম, বই বের করা যাবে। তবে দিতে হবে পঁয়ত্রিশ হাজার। ত্রিশেও করে দিতে পারবেন বলে জানালেন এক কবি। কিন্তু সে কী করে হয়! রাতারাতি পনেরো-বিশ হাজার টাকা ম্যানেজ করা তো মুখের কথা নয়। এসব তো বাসায় জানানোও যায় না। আবার লেখক হবার মোহ থেকে মুখ ফেরাতেও পারি না। অতএব লেখা প্রকাশের প্রত্যাশায় এলাকার একজন কলেজ-শিক্ষকের শরণাপন্ন হলাম। তাঁর বেশকিছু বই বেরিয়েছে। ঢাকায় নাকি ভালো চেনাজানা আছে। নিজের একটা প্রকাশনীও নাকি আছে তাঁর। সেখানেই পাণ্ডুলিপি জমা দিতে চাইলাম। তিনি প্রথমে পঁচিশ চাইলেও শেষে তেইশেই করে দিতে চাইলেন।
এবার মলাটবাঁধা বইয়ের মুখ দেখার আশায় আমার দিন কাটে না রাত কাটে না অবস্থা। আমার মতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করল আরও দুএকজন বন্ধু। অথচ ক’দিন বাদে জানা গেল, আমার পাঠানো মেইলটা নাকি ওপেনই হচ্ছে না। লেখাটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। যেখানে টাইপ করিয়েছিলাম সেখানে ছুটলাম। ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন অপটু টাইপ-রাইটার। তবু চেষ্টা চলল খুব। এ করতে গিয়ে কখন যে চূড়ান্ত সংশোধিত পাণ্ডুলিপির বদলে খসড়াটা মেইল হয়ে গেল, তা টেরই পেলাম না। যখন বই হাতে এল তখন তা প্রথম লক্ষ করল প্রথম দিন থেকে অদ্যাবধি আমার অন্যতম রুমমেট, প্রিয় বন্ধু। বলল,
–এই, আমার নামের বানানটা ভুল কেন?
–না তো, ভুল থাকবে কেন? আমি তো ঠিক করে এসেছি।
–দেখ তুই।
দেখলাম, ভূমিকার যেখানে ওর নাম জুড়ে দিয়েছিলাম, সেখানে সত্যি সত্যিই ভুল রয়ে গেছে। কিন্তু আমার তো দিব্যি মনে পড়ছে, একই ভুল আমি একবার ঠিকও করেছি। তাহলে? দ্রুত পাতা উল্টিয়ে আরও কয়েক জায়গা দেখে নিলাম। নাহ! ঠিক নাই। ঘটনা ঘটে গেছে। আলোর মুখ দেখেছে খসড়া কপিটি।
এতদূর পর্যন্ত হলেও কথা ছিল। পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করে নেয়া যেত। কিন্তু আসল গলদটা ছিল অন্য জায়গায়। সেদিনই জানলাম, বইটিতে প্রকাশনী-পরিবেশক সংশ্লিষ্ট যেসব তথ্য দেয়া আছে সেসব সত্য নয়। আসলে রাজশাহীর একটা প্রেস থেকে ছেপে বেরিয়েছে বাক্যগুলো। কোন প্রেস থেকে জানতে চাইলে, সেই তিনি আজ পর্যন্ত কিছু জানাননি। জানানোর মধ্যে শুধু এটুকু জানিয়েছেন যে, এখন আর তাঁর মনে নাই!
যেদিন কুরিয়ারে করে বই এল, সেদিন বন্ধুদের অনেকেই পুজোর অনুষ্ঠানে (ক্যাম্পাসে প্রতি বছর সরস্বতীপূজা অনুষ্ঠিত হয়) না-থেকে বই আনতে গিয়েছিল দলবেঁধে। সে কী উৎসাহ উল্লাস! বই আসবে, বই আসছে! তাদের বন্ধুর বই বেরুচ্ছে বইমেলায়। আর আমিও কী উৎসাহীই না হয়ে উঠেছিলাম! অথচ তার পরমুহূর্তেই সে-কথা জানলাম, ছিঁড়ে গেল সাধের সুতো! কেউ একজন দুমড়েমুচড়ে দিল আমার স্বপ্নকুঁড়িটা!
মনে মনে ভেঙে পড়েছিলাম আমি। সেদিনই ভেঙে পড়তে পারত লেখক হবার স্বপ্নটাও। কিন্তু না, পড়েনি। আমার বন্ধুরা, এই প্রিয় বন্ধুরাই, তাকে ঝরে পড়তে দেয়নি, মরে যেতে দেয়নি; বাঁচিয়ে রেখেছিল, বাঁচিয়ে রেখেছে।
এখনও অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। যেজন্য ষোলো সালের সেই স্বপ্নভঙ্গ ভুলে গিয়ে বিহঙ্গের মতো ভেসে বেড়াচ্ছি বাংলা সাহিত্যের অনন্ত আকাশে, দুরন্ত সাহসে, গেল সতেরো সাল থেকে। আর হ্যাঁ, সে খসড়াটি তখনই ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অর্থলগ্নির একটা ব্যাপার ছিল বলে সে দুঃসাহস দেখাতে পারিনি। তবুও স্বভাবতই বন্ধুবলয়ের বাইরে সে বইটির প্রচারণা প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু বন্ধুদের ক’জন নিজ থেকে প্রচারণা চালিয়েছিল নিজেদের মধ্যে, সিনিয়রদের মধ্যে, জুনিয়রদের মধ্যে। সবমিলিয়ে কয়জন কিনেছে, উল্টেপাল্টে দেখেছে; অশ্লীল মনে করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কয়জন; আর এ আমিই আক্ষরিক অর্থেই কত কপি যে জলে ফেলে দিয়েছি, সেসবের অবতারণা অবান্তর অপ্রাসঙ্গিক। তবে আমার সমস্ত লেখকসত্তায় অনন্য স্মৃতি হয়ে থাকবে সেই দিনগুলো, এই দিনগুলো; এই অনাবিল ভালোবাসাগুলো।
প্রিয় বন্ধু, তোদের সকলের জন্য রইল হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা। যেমনটি আছিস, জন্ম-জন্মান্তরেও এমনটি থাকিস। জানিস, একটি বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব বন্ধুত্বের বাইরে আর কিছু চায় না, চাইতে জানে না।
পাদটীকা: ওই মলাটবাঁধা বইটা খাড়ির জলে ফেলে দিলেও সেই বড়োগল্পের পরিমার্জিত রূপ ‘ঐশ্বর্য’র প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় ছেপেছে। পুরোটা আগামী অক্টোবর মাসে এক অন্তর্জালে প্রকাশিত হবার কথা রয়েছে। যদিও এটিতেও আবার কাটছাঁট করেছি। আসলে সেটাকে আমার প্রথম বই বলতে চাই না। ষোল সালের সেই ঘটনাটাকে অভিজ্ঞতা হিসেবে নিয়েছি মাত্র। মূলত পত্রপত্রিকায় সিরিয়াসলি লেখালেখিটা শুরু করেছি সতেরো সালের এপ্রিল থেকে, তীরন্দাজে এক পাঠ-প্রতিক্রিয়া প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
সাহিত্য-জগৎ ও তার বাইরের কিছু প্রিয় মানুষের কাছ থেকেও অনেক বেশি অনুপ্রেরণা পেয়ে যাচ্ছি। এ সুযোগে তাঁদের উদ্দেশে প্রকাশ করছি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা। সব ঠিক থাকলে আশা করছি আগামী একুশ সালে আলোর মুখ দেখবে আমার প্রথম বই।
১৩ আশ্বিন ১৪২৬, এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর।
আরো পড়ুন: শাহিন চাষীর কবিতা